জেরুজালেম শহরের সঠিক ইতিহাস জানুন
জেরুজালেমের ইতিহাস
★ ভূমিকা :জেরুজালেম ইসলামী ইতিহাসের অবিচ্ছেদ অংশ। এই স্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সহস্র বছরেরও প্রাচীন ইতিহাস। জড়িয়ে রয়েছে তার সাথে বহু নবী রাসূলদের (সাঃ)স্মৃতি। শহরটি বর্তমানে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দাবি করে আসছে। বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলোর একটি বলে গণ্য করা হয় এই শহরকে। জেরুজালেমের নাম ইসলাম – ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। প্রাচীন কাল থেকেই ভয়াবহ সংঘর্ষ চলে আসছে নানান কিছুকে কেন্দ্র করে। বিশ্ব বিধাতা আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর কয়েকটি স্থানকে মর্যাদা দিয়েছেন তারমধ্যে অন্যতম হলো জেরুজালেম।প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা জেরুজালেমকে জেনে নেই।
★জেরুজালেম প্রতিষ্টা: খ্রীস্টপূর্ব ৩০০ সালে ইয়াবুসি গোত্রের শাসক মালিক সাদেক এ শহরটি নির্মাণ করার মনস্থ করলেন। তখন ইয়াবুসি (বা জেবুসি) গোত্রের লোকেরা সেখানে বাড়ি ঘর তৈরী করেন এবং তারা নিজেদের আত্মরক্ষার্থে একটি দূর্গও নির্মান করেন।তারা প্রায় দু-হাজার বছর পর্যন্ত এ শহরটিকে তাদের অধিনে রাখেন। তখন তিনি এর নাম রাখেন “ইউরোসালেম”। এটি একটি কেনানি শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে “শান্তিপ্রিয় “। শাসক মালিক সাদেক খুবই শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন, তাই শহরটির নাম “ইউরোসালেম” রাখা হয়, যা আজ জেরুজালেম নামে পরিচিত।জেরুজালেম শহরের আরো কয়েকটি নাম রয়েছে : ১:-মদিনাতুল হক। ২. মদিনাতুল্লাহ। ৩:-মদিনাতু-ত্বাহেরাহ।
★ ভৌগোলিক অবস্থান : এশিয়া মহাদেশের মধ্যপ্রাচ্যে ভূমধ্যসাগর ও মৃত সাগরের মধ্যবর্তী যোধাইয়ান পর্বতের নিচু মালভূমিতে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নগরী। জেরুজালেমের আবহাওয়া – জেরুজালেমের আবহাওয়া মাঝারি ধরণের। শীত ও গ্রীষ্ম বাদ দিয়ে অন্যান্য সময় সেখানকার তাপমাত্রা গড়ে ১৮ সেন্টিগ্রেড থাকে সেখানকার ফসল,গাছ-পালা এবং কৃষি জমিগুলো ভূমধ্যসাগরের আবহাওয়া ভোগ করে। জানুয়ারী মাসে সর্বাধিক ঠান্ডা পড়ে তখন তাপমাত্রা থাকে ৯.৭ সেন্টিগ্রেড। পক্ষান্তরে আগস্ট মাসে সর্বাধিক গরম পড়ে তখন তাপমাত্রা থাকে ২৫ সেন্টিগ্রেড। শীতকালে সর্বনিন্ম তাপমাত্রা থাকে ৪ সেন্টিগ্রেড ।
★ ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতিঃ মূলত ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের কোনো রাজধানী নেই বললেই চলে। এটি ফিলিস্তিনের রাজধানী জেরুজালেমকে দখল করে নিজেদের রাজধানী দাবি করে। ইসরাইলের সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক ২০১৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুসালেমকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসকে তেল আবিব থেকে জেরুসালেমে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনায় নির্দেশ দেন, যা সম্পূর্ন অনৈতিক কারন।
জেরুজালেম হচ্ছে ফিলিস্তিনের রাজধানী যা এখন অবৈধ বর্ণবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের দখলে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পের সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানান এবং ঘোষণাটির প্রশংসা করেন।
★ বায়তুল মোকদ্দাস কেন এত মর্যাদাপূর্ণঃ মর্যাদার দিক থেকে মক্কা মদিনার পরে তৃতীয় শহর হল জেরুজালেম। এই শহরের নাম হাদিসে পাকে এসেছে । আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের প্রথম ক্বিবলা বায়তুল মুকাদ্দাসকে রেখেছেন এই শহরের মধ্যে। এখানে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে বহু সাওয়াব পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে – ‘কাবা শরিফ তথা মাসজিদুল হারামে নামাজে এক লাখ গুণ সওয়াব, মদিনা শরিফে মসজিদে নববিতে নামাজে পঞ্চাশ হাজার গুণ সওয়াব, বায়তুল মুকাদ্দাসে নামাজে পঁচিশ হাজার গুণ সওয়াব।
অসংখ্য নবী রাসুলদের জন্মভূমি হলো এই শহর। এই স্থান অসংখ্য নবী–রাসুলের স্মৃতিবিজড়িত, এর আশপাশে অনেক নবী–রাসুলের সমাধি রয়েছে। এটি দীর্ঘকালের ওহি অবতরণের স্থল, ইসলামের কেন্দ্র এবং ইসলামি সংস্কৃতির চারণভূমি ও ইসলাম প্রচারের লালনক্ষেত্র। এই পবিত্র ভূমির ভালোবাসা গাঁথা রয়েছে প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ের গভীরে। এ শহরের মর্যাদার বহু কারণ রয়েছে যা মুমিনদের অজানা নয়।
★মে’রাজের সূচনা এই শহর থেকে: ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী মুহাম্মাদের (সা:) নবুওয়াত প্রকাশের একাদশ বৎসরের (৬২০ খ্রিষ্টাব্দ) রজব মাসের ২৬ তারিখের দিবাগত ইসলামের নবী মুহাম্মাদ প্রথমে কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসায় গমন করেন এবং সেখানে তিনি নবীদের জামায়াতে ইমামতি করেন। অতঃপর তিনি বোরাক নামক বিশেষ বাহনে আসীন হয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করেন। ঊর্ধ্বাকাশে সিদরাতুল মুনতাহায় তিনি আল্লাহ’র সাক্ষাৎ লাভ করেন। এই সফরে ফেরেশতা জিবরাইল তার সফরসঙ্গী ছিলেন।
কুরআন শরিফের সূরা বনী-ইসরাঈল এর প্রথম আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে :
“سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنْ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّه هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ.
বঙ্গার্থ : “পবিত্র সেই মহান সত্তা, যিনি তাহার এক বান্দা (মুহাম্মদ)-কে মসজিদে হারাম (কাবাঘর) হইতে মসজিদে আকসা (বাইতুল মোকাদ্দাস) পর্যন্ত পরিভ্রমণ করাইয়াছেন। ইহার মধ্যে তাহাকে অসংখ্য নিদর্শনাবলী দেখানো হইয়াছে।
★ মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা জেরুজালেমে: প্রথমে ‘কাবা’ কিবলা থাকলেও মসজিদুল আকসা বা ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ স্থাপনের পর এটি কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ওহি লাভ ও নবুয়ত প্রকাশের সময় ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ই কিবলা ছিল। নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই কিবলা পরিবর্তন হয়ে পুনরায় ‘কাবা’ কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়। মদিনা শরিফে দুই কিবলার মসজিদও রয়েছে। ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে ‘তাহবিলে কিবলা’ বা কিবলা পরিবর্তন বলা হয়। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৪২-১৫১)। এই থেকেই ইসলামের দ্বিতীয় ক্বিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা হিসেবে পরিচিত হয়।
★ মুসলিমদের দখলে জেরুজালেম: দ্বিতীয় খলিফাতুল মুসলিমিন ফারুকে আজম হজরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে ৬৩৮ সালে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। ১০৯৬ সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা সিরিয়া ও ফিলিস্তিন জবরদখল করে নেয়। ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সিপাহসালার সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহঃ) পুনরায় জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। আরো জানুন
★জেরুজালেম রক্ষায় আমাদের কর্তব্য: জেরুজালেম মুসলমানদের, আল- আকসা মুসলমানদের, ফিলিস্তিন মুসলমানদের সুতরাং তার দায়-দায়িত্ব বিগত সময়ের তুলনায় অনেক বেশি, আল্লাহর দরবারে তার প্রতিদান- সম্মানও অনেক বেশি। ঝুঁকি ও ক্ষতির ভয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া, সময়ের প্রতিকূলতার কাছে পরাজয় স্বীকার করা পুরুষের কাজ নয়, কাপুরুষের কাজ।
মুসলিম জাতিকে অবশ্যই সাহসের পরিচয় দিতে হবে মুসলিমদের এগিয়ে আসতে হবে আগামী দিনের জন্য। হাতে এখনো যতটুকু সময় আছে সেটাকে প্রস্তুতির কাজে ব্যয় করুন, গুরুত্ব দিন, দায়িত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করুন। আগামী দিনে কর্মের ময়দানে উম্মতের সৌভাগ্য, বিশ্বের সৌভাগ্য নির্মাণে অবদান রাখুন।”গাফেল হইও না সময় কারো জন্য বসে থাকেনা”।
আমাদের অবস্থান কেমন? আমরা তো আমাদের মহান পূর্ববর্তীদের দ্বীনি হিম্মতের কথা, সাহসীকতা ও বিরত্বময় কথা, ও চেতনার কথা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করি তাদেরকে অনুসরণ- অনুকরণ করি সুস্পষ্ট ভাষায় সাক্ষ্য দেই যে, তারা কখনো ইসলামের শুত্রু- তাগুতের সামনে মাথা নত করেনি। দেখার বিষয় হল আমাদের সম্পর্কে আমাদের পরবর্তীরা এই সাক্ষ্য দেবে? ইতিহাসের পাতায় আমরা কি সেই অবদান রেখে যাচ্ছি ?
হায় আফসোস! আমাদেরকে আর কতদিন গাফিলতির নিদ্রাছন্ন করে রাখবে?এখনি সময় সিংহের গর্জন দিয়ে অলসতার গর্ত থেকে বেরিয়ে রুখে দাঁড়াও দখলদারদের, মুক্ত কর পূন্যভূমিকে। হে আল্লাহ আমাদের গৌরব ফিরিয়ে দাও। আমিন।ইয়া রাব্বাল আলামীন।