Real history

আলাউদ্দিন বে- উসমানীয় সালতানাতের প্রথম উজিরে আজম

আলাউদ্দিন বে- উসমানীয় সালতানাতের প্রথম উজিরে আজম

আসসালামু আলাইকুম, আশা করি সকলেই ভালো আছেন? উসমান গাজীর পুত্র আলাউদ্দিন পাশা, ইতিহাসে নম্র ভদ্র ও ক্ষমতার লোভহীন যত শাহজাদা ছিলেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।

আপনারা অটোমান সাম্রাজ্যের অনেক সুলতান এবং শাহজাদাদের গৌরবময় গল্প পড়েছেন এবং শুনেছেন। সিংহাসন নিয়ে যুদ্ধ প্রতিটি যুগে তীব্র আকার ধারন করেছিল। কিন্তু গৌরবময় এক সময় ছিল, যখন দুই ভাই সিংহাসনের জন্য লড়াই না করে একে অপরকে সমর্থন করেছিলো। এবং এই দুজনের উদাহরণ জীবন্ত হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়৷

এই দুই শাহজাদারা ছিলেন উসমানীয় সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান গাজীর দুই পুত্র উরহান বে ও আলাউদ্দিন বে। পরবর্তীতে এই বিশাল অটোমান সাম্রাজ্যের একজন হয়েছিলেন ভবিষ্যতের সুলতান এবং অন্যজন হয়েছিলেন সম্রাজ্যের উজির। আমরা ইতিমধ্যেই সেই মহান ওরহান গাজীর জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি, আপনারা চায়লে সেই আলোচনা আমাদের সাইট থেকে দেখে নিতে পারেন৷

আমরা আজকেআলাউদ্দিন বের মহান জীবনী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য জানতে ভিডিওটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন।

আলাউদ্দিন বে, যাকে অটোমান সাম্রাজ্যে উল্লেখ করা হয়েছে আলাউদ্দিন পাশা হিসেবে। তবে তিনি আলাউদ্দিন বে, আলী পাশা নামেও পরিচিত। আলাউদ্দিন পাশা সোগুত শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আলাউদ্দিন পাশা বা আলাউদ্দীন বে ওসমান গাজী এবং বালা হাতুনের সন্তান, এবং তিনি ছিলেন ওরহান গাজীর ছোট ভাই। তবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে এই বিষয়ে মতভেদ আছে।

অধিকাংশ ইতিহাস অনুসারে, আলাউদ্দিন পাশা ছিলেন ওসমান বের প্রথম পুত্র, এই কথা শুনে আপনি নিশ্চয়ই হতবাক হচ্ছেন। কারন সাধারণত আমরা সবাই জানি যে, ওরহান গাজী ছিলেন ওসমান গাজীর প্রথম সন্তান।কিন্তু অনেক ইতিহাসবীদ বলেন, আলাউদ্দিন বে ছিলেন প্রথম সন্তান, এই কারণেই পিতার মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন বেকে সিংহাসনে বসার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো৷ কিন্তু আলাউদ্দিন বে, উচ্চ মনোবলের অধিকারী ছিলেন, এজন্য তার ছোট ভাইয়ের যোগ্যতাকে স্বীকার করে তাকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছিলেন৷

এবং যেহেতু তাকে আলাউদ্দিন পাশা বলে ডাকা হতো, কিছু কিছু ইতিহাস মতে প্রাচীন তুর্কি ঐতিহ্যে অনুসারে বড় ভাইকে পাশা উপাধি দেওয়া হতো৷ সুতরাং আলাউদ্দিন পাশা বড় নাকি উরহান গাজী বড় এই বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে।

আলাউদ্দিন বের প্রাথমিক জীবনের ঘটনা ইতিহাসে তেমন লিপিবদ্ধ নেই। কিছু ইতিহাসবিদ তার জন্ম সাল বলেছেন ১২৮০ সাল, আবার কেউ বলেন ১২৮২ সাল । কিন্তু আজ পর্যন্ত, কোন চূড়ান্ত সাল নির্ধারণ করা যায়নি৷ তবে বিখ্যাত তুর্কি সিরিজ কুরুলুস ওসমানে আলাউদ্দিন পাশাকে ওরহান গাজীর ছোট ভাই হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে।

তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানা কঠিন কারণ ইতিহাসে তার সম্পর্কে খুব বেশি বিবরণ নেই, যেমন তিনি তার শৈশব কোথায় কাটিয়েছিলেন এবং কোথায় তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন সে সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট তথ্য নেই।
তবে বলা হয় যে, আলাউদ্দিন আলী তার পিতামহের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার নানা ছিলেন শেইখ এদেবালি, আলাউদ্দিন পাশা তার বেশিরভাগ সময় নানার আশ্রমে কাটিয়েছেন, এবং সেখান থেকেই তিনি পড়াশোনা করেছেন, যেহেতু তার বেশিরভাগ সময় দরবেশদের সাহচর্যে কেটেছে। সুতরাং আক্রমণাত্মক যোদ্ধা হওয়ার পরিবর্তে তিনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত লাভ করেন৷

তবে এমন নয় যে, তিনি দরবেশদের সাথেই সব সময় ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র এবং তরবারি যুদ্ধের দক্ষতায়ও পারদর্শী ছিলেন আলাউদ্দিন পাশা৷ কিন্তু কিছু ইতিহাসবিদ এই বিষয়ে একমত নন, ইদ্রিস বিটলিসির মতে, আলাউদ্দিন পাশা ওরহান গাজীর মতো যুদ্ধে আগ্রহী ছিলেন না। এবং নবগঠিত উসমানীয় সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের পরিবর্তে, তিনি যুদ্ধবিহীন শান্তিপূর্ণ ভাবে থাকতে পছন্দ করতেন৷ এজন্য মনে করা হয় যে, এই কারণেই ওরহান বে’কে সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু আলাউদ্দিন পাশা রাষ্ট্রীয় বিষয় পরিচালনায় প্রশিক্ষিত ছিলেন৷

ইতিহাস বলে, আলাউদ্দিন পাশা নাম অজানা এক বীমের কন্যাকে বিয়ে করেন এবং এই বিবাহের পর তার প্রায় ৮টি সন্তানের জন্ম হয়। ৫ জন ছেলে ও ৩ জন মেয়ে, তারা হলেন কিলিচ বে, হিজার বে, মেহমেদ বে, ইব্রাহিম বে এবং শাহী বে, তাকি হাতুন, আয়শে হাতুন ও পাশা হাতুন।

১৩২৩ অথবা ২৪ সালে সাহসী ওসমান গাজীর মৃত্যুর পর ঘঠে আসল ঘটনা, সবাই যখন ভাবতেছিলো উসমান গাজীর পুত্রদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হতে চলেছে। কিন্তু এই দুই ভাই একটি এমন ইতিহাস তৈরি করেছিলেন, যা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে, আলাউদ্দিন পাশার পিতার মৃত্যুর পর তুর্কি ঐতিহ্য অনুসারে একটি আলোচনা সভা ডাকা হয়েছিলো।

যেখানে ওরহান বের পরিবর্তে আলাউদ্দিন বেকে সুলতান হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু আলাউদ্দিন বে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই বলে যে, তার পিতা ওরহান বেকে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে পছন্দ করে গিয়েছেন৷ বলা হয়ে থাকে যে, ওরহান বে সাম্রাজ্যকে দুটি সমান ভাগে ভাগ করতে বলেছিলেন, যাতে দুই ভাই সমান ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কিন্তু আলাউদ্দিন বে বিরোধিতা করেন।

কারন তিনি সাম্রাজ্যকে ভাঙতে রাজি হননি৷ কিছু ঐতিহাসিকদের মতে তৎকালীন সময়ে আহি নামে এক সংগঠন ছিল, তারাও ওরহান বের উপর ক্ষমতা প্রদানকে সমর্থন করেছিলেন। এবং সে কারণেই উরহান বে মহান রাজ্যের শাসক হয়েছিলেন৷ আলাউদ্দীন পাশাও তার ভাইকে বেশী যোগ্য মনে করেছিলেন, এবং তার ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি তাকে এই সিংহাসনের অধিকারী বলে মনে করেছিলেন৷ এবং তার প্রতি আনুগত্যের শপথও করেছিলেন।

যদিও আলাউদ্দিন বে সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন, এরপর পাশ্ববর্তী এক গ্রামের একটি দরবেশ মহলে কিছু সময়ের জন্য দরবেশ হিসেবে কাজ করেছেন, এই গ্রামটির অবস্থান ছিল বুর্সার পশ্চিমে , এরপর আলাউদ্দিন বে ওরহান বের আমন্ত্রণে রাজ্যের উজিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ওরহান গাজী যখন বিজয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখন আলাউদ্দিন বে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম উজির হিসেবে প্রশাসনিক পুনর্গঠন নিয়ে কাজ করেন।

দুই ভাইয়ের মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতাকে কোনো কোনো ঐতিহাসিকবিদ নবী মুসা ও হারুনের সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৩২৮ বা ১৩২৯ সালের সময় আলাউদ্দিন বে, ওরহান বের সাথে তার সাম্প্রতিক ইজনিক শহর বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানাতে তার সাথে দেখা করেছিলেন। এই সফরের সময়, আলাউদ্দিন বে অটোমান সাম্রাজ্যে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম দিকের দক্ষতা উন্নত করার জন্য ওরহান বেকে তিনটি পরামর্শ দেন। এই তিনটি পরামর্শের মধ্যে রয়েছে একটি আর্থিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, একটি অফিসিয়াল অটোমান পোশাক নির্বাচন এবং সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ পুনর্গঠন। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ১৩২৮ এবং ১৩২৯ সালে রৌপ্যমুদ্রা প্রকৃতপক্ষে ওরহান বের নামে তৈরী করা হয়েছিল। মুদ্রার উপর পাশে ইসলামের বিশ্বাসের একটি বানী লিখাছিল। আরবীতে লিখা ছিল আল্লাহ তার রাজত্বকে চিরস্থায়ী করুন।

বাইজেন্টাইনদের মতো একই ঐতিহ্যে মেনে মাথায় প্রচুর সূচিকর্ম করা উপাদানের পোশাক তৈরী করা হয়েছিল, সরকারী এবং সামরিক কর্মীদের জন্য একজন সেনাপ্রধান বানানো হয়েছিল, যদিও সাধারণ জনসাধারণকে তারা যা খুশি তা পরিধান করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, “অত্যন্ত সম্মানিত আরবি ম্যাক্সিম, ‘সর্বোত্তম পোশাক সাদা কালারের ভিত্তিতে একটি সাদা অনুভূতের ক্যাপ নির্ধারণ করা হয়েছিল বিশেষ সেনাদলের জন্য। এইভাবে, সামরিক এবং রাজ্যের বিশেষ সেনারা দক্ষতা অর্জন করেছিল।

এই সবকিছু পরিচালনা করেন আলাউদ্দিন পাশা। অবশেষে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, সামরিক সংস্থা বাহিনী একটি সম্পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেন, আলাউদ্দিন পাশা প্রস্তাব করেছিলেন যে সামরিক বাহিনীকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হবে এবং প্রতিটি বিভাগের নিয়ন্ত্রণে একজন কমান্ডার রাখা হবে। এছাড়াও, আলাউদ্দিন পাশা প্রস্তাব করেছিলেন যে পদাতিক সৈন্যদের নিয়ে একটি দল গঠন করা হবে যাদের যুদ্ধের সময় যুদ্ধের জন্য তলব করা যেতে পারে।

এই সৈন্য বাহিনী যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন কোন প্রশিক্ষণ ছিল না, পরবর্তীতে আলাউদ্দিন পাশা তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন, এবং বিশেষ বিশেষ যুদ্ধে এই বাহিনী কে ব্যবহার করা হতো। এটাই ছিল আলাউদ্দিন বে পাশা উপাধি পাওয়ার প্রধান কারণ। কিছু ইতিহাস মতে, আলাউদ্দিন পাশা পরামর্শদাতা হিসাবে ওসমান গাজীর সাথেও সময় কাটিয়েছেন,

আলাউদ্দিন বে সেনা কমান্ডার হিসেবে কিছু যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ইতিহাসবিদ এমের কবির মুজাহিদ” তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে আলাউদ্দিন পাশা সেনাবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। আবার কিছু ইতিহাসবিদ লিখেছেন যে তিনি মালতিপ নামক এক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যুদ্ধ জয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন, তবে এ সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট তথ্য নেই।

এটা মনে করা হয় যে উসমানীয় সৈন্যদের অন্যান্য রাজ্যের সৈন্যদের থেকে আলাদা করার জন্য সাদা টুপি বা ক্যাপ পরার প্রথাটি আলাউদ্দিন বে দ্বারা প্রবর্তন করা হয়েছিল এবং ওরহান বে তার সুপারিশে বিলেসিকে সাদা পোশাকও তৈরি করেছিলেন। চান্দারলি কারা হালিল পাশার সাথে একসাথে, তিনি প্রথমবারের মতো স্থায়ী পথচারী এবং মুসলিম ইউনিট প্রতিষ্ঠার পথপ্রদর্শক ছিলেন, সেনাবাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের সংগঠন, দিওয়ান সংগঠন প্রতিষ্ঠা, পাকানো পাগড়ি পরা এবং মুদ্রা ছাপানোর জন্য আলাউদ্দিন বেকে আসল কারিগর মনে করা হয়।

উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় বিষয়ে তার অংশগ্রহণের পাশাপাশি, আলাউদ্দিন বে খুব ধার্মিক, শান্ত জীবনযাপন করেছিলেন বলে মনে করা হয়। তিনি বেশ কয়েকটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। বুরসা শহরে তার একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল; এই মসজিদটি বুরসায় নির্মিত প্রথম মসজিদ হিসেবে পরিচিত। কিছুদিন উজির এবং সেনা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর, আলাউদ্দিন বে তার দরবেশ জীবনে ফিরে আসেন। Watch in English

আলাউদ্দিন পাশা পরোপকারের জন্য পরিচিত ছিলেন। তার বয়স কত এবং কি কারণে তার মৃত্যু হয়েছে তা সঠিকভাবে জানা যায়না। ধারণা করা হয় যে তিনি ১৩৩৩ সালে বুর্সায় মারা যান। কিছু সূত্র আরও জানায় যে তিনি একটি যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। এটিও বলা হয় যে তিনি ১৩৩৩ সালে বিগা নামক দুর্গে মারা যান। তাঁর পুত্র হিজার বের মাধ্যমে তার কাজ অব্যাহত ছিল। আবার কিছু ইতিহাসবিদ বলেন: আলাউদ্দিন বে ১৩৩১ বা ১৩৩২ সালে মারা যান এবং তাকে বুরসাতে সমাহিত করা হয়। তিনি তার ভাই ওরহান গাজীর পাশের সমাধিতে শায়িত আছেন।

আরো ঐতিহাসিক নিউজ পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button